ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

ভোট একটি পবিত্র আমানত

Md.Alamgir-233x300মাওলানা মুহাম্মদ আলমগীর :

ভোট শব্দের ব্যাখ্যা: ভোট একটি ইংরেজি শব্দ। বাংলায় রায়, আরবীতে বাইয়াত। বিভিন্ন অভিধানে ভোটের যে অর্থ পাওয়া যায় তা হলো-সাক্ষ্য দেওয়া, সুপারিশ করা, মত দেওয়া, প্রতিনিধিত্ব নিযুক্ত করা। অনুমোদিত পন্থায় নিজের ইচ্ছা বা মত প্রকাশ করা। কোন ব্যাপারে নিজের পছন্দনীয় জিনিসের পক্ষে রায় বা সমর্থন দেওয়া। দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে থেকে কোন একজনকে সমর্থন দেওয়া। দুই বা ততাধিক ব্যক্তির মধ্যে থেকে কোন একজনকে সমর্থন দেওয়া বা কোন একজনের আদর্শকে পছন্দ করা। আমানতের সঠিক ব্যবহার করা ইত্যাদি। প্রচলিত সমাজে ভোট বলা হয় কোন ব্যক্তি বা দলের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যে ব্যক্তি বা দলের প্রতীকে সীল প্রদান করা। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাসহ মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ গাইড লাইন রয়েছে। আল্লাহ যুগে যুগে নবী রাসুল (সঃ) প্রেরণ করেছেন রেসালতের দায়িত্ব দিয়ে। আর রেসালাতের মূল উদ্দেশ্য হলো জমিনে আল্লাহর খেলাফত কায়েম করা। আল্লাহ বলেন, “তিনি সেই মহান আল্লাহ যিনি তাঁর রাসুলকে সত্য দ্বীন সহ পাঠিয়েছেন যাতে অন্য সব বাতিল মতবাদ ও নিয়ম কানুন এর উপর বিজয়ী করেন। সুরা ফাতাহ, সূরা সাফ আর খেলাফত কায়েম হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের সুস্পষ্ট মতামতের ভিত্তিতে। খেলাফত কায়েম করার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া এবং ভোট দেওয়া ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। কারণ মুসলমানের সকল কাজেই ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছে”।। “নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তোমাদের যাবতীয় আমানত উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে অর্পন করার নির্দেশ দিয়েছেন” (সুরা নিসা-৫৮)।আল্লা(মা’রিফুল কুরআন ১ম খন্ড)। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, আমি এই আমানতকে আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে পেশ করলাম। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করতে রাজী হলো না (তারা ভয় পেল) কিন্তু মানুষ তা নিজের ঘাড়ে তুলে নিল। নিঃসন্দেহে সে বড় জালিম ও মুর্খ (আহযাব ৭২)। এই আয়াতে খেলাফতের দায়িত্বকেই আমানত বলা হয়েছে। আর খেলাফতের দায়িত্ব ভোটের মাধ্যমেই একজনকে প্রদান করতে হয়। কিন্তু খেলাফতের এ মহান আমানত যদি কেউ সামান্য টাকা বা দুনিয়াবী কিছুর বিনিময় বিক্রি করে তাদেরকে আল্লাহতালা বড় জালিম বড় জাহিল ও মুর্খ বলেছেন। মুমিনদের যাবতীয় কাজ বিশেষ করে সামগ্রিক বিষয় পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ বলেন তারা নিজেদের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে পারস্পরিক পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে (সুরা আশ শুরা, আয়াত-৩৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহর নবীর উদ্দেশ্যে বলেন, “যাবতীয় বিষয় তাদের সাথে পরামর্শ কর” (আলে ইমরান ১৫৯)। উপরোক্ত আয়াত সমূহের তফসীরে মুফতী শফি, আল্লামা সইয়ে আবুল মাল মওদুদী ও আল্লামা সাইয়েদ কুতুবসহ বিশ্ববিখ্যাত মুফাসসিরগণ বলেছেন যে, এ আয়াতদ্বারা সমগ্র বিশ্ব জনমতের ভিত্তিতে নেতা বা শাসক নির্বাচনের মূলনীতি সর্বজন স্বীকৃত সত্য পরিণত হয়েছে এবং জাতীয় ও সামগ্রিক বিষয়ের নেতা বা শাসক নির্বাচিত হবে জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে। নেতা বা শাসক নির্বাচনের জন্য জনগণের যে স্বাধীন মতামত দেওয়া হয় তাকেই ভোট বলে। আরবীতে বাইয়াত। হাদিস শরীফে ভোটের বিষয় অসংখ্য স্থানে উল্লেখ করেছেন। আবু দাউদ, তিরমিযীসহ সুনান কিতাব সমূহে এসেছে। রাসুল (সঃ) বলেন যারা জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিবে তারাই সঠিক কাজ করবে। বর্তমান যুগে পরামর্শ বা মতামতকে ভোট বলা হয়। রাসুল (সঃ) আরো বলেন, যদি কেউ কোন জালিমকে জেনে শুনে ভোট দেয় বা সহযোগিতা করে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেল (আবু দাউদ নাসায়ী)।
রাসুল (সঃ) আরো বলেন, সর্বপেক্ষা ভাল লোকই জাতির নেতৃত্ব দিবেন (বুখারী ও মুসলিম)। রাসুল (সঃ) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে তথা ভোট নিয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন (তফসীর ইবনে কাছারী ও তাবারী)। রাসুল (সঃ) বদর, উহুদ, খন্দক ইত্যাদি জিহাদে সাহাবীদের ভোট গ্রহণ করেই কার্য সম্পাদন করেছেন। রাসুল (সঃ) ইনতেকালের পর মুহাজির ও আনসারদের ভোটের মাধ্যমে হযরত আবুবকরকে খলিফা নির্বাচিত করা হয়। সুদীর্ঘ তিনদিন পর্যন্ত আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভোট চলছিল এবং নির্বাচন সমাপ্ত করে আবুবকর খলিফা ঘোষিত হবার পর রাসুল (সঃ) এর দাফন কার্য সমাপ্ত করেন (আল বেদায়া আন নেহায়া সহ সীরাত ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহ)। হাদিস শরীফ থেকে আরো জানা যায়, কিয়ামতের ময়দানে জমিনের তথাকথিত ভাল মানুষকে উঠানো হবে যারা সালাত, যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ পালনসহ ভাল কাজ করতেন কিন্তু তার আমলনামায় চুরি, জেনা, খুন, সন্ত্রাস ও অশ্লীলতার প্রসারসহ বড় বড় গুনাহ সে দেখতে পাবে এবং আল্লাহকে বলবে আল্লাহ অপরাধতো আমি করি নাই তখন আল্লাহ বলবেন, “হে আমার বান্দা তুমি নিজে কর নাই তবে করার জন্য ক্ষমতা দিয়েছ। তোমার ভোট পেয়ে ক্ষমতাসীন হয়ে যে জেনা করল, গরীবের হক চুরি করল, মানুষের উপর জুলুম করল, খুন খারাবীসহ যাবতীয় অপরাধের দায়ভার তোমাকে নিতে হবে”। আর এ দায়ভার নিতে গিয়ে জাহান্নামে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। উম্মতের ইজমা ইমাম ইবনে আবদুল বার (রাঃ) বলেন, সকল উম্মত একমত হয়েছেন ভোট একটি শরীয় বিষয় অতএব ইহা শরীয় বিধান মতে প্রয়োগ করা একান্ত জরুরী। ইমাম মাওয়ারাদি (রঃ) বলেন, ভোটের মাধ্যসে সৎ ও যোগ্য নেতা নির্বাচন করতে হবে- যাতে তার প্রতি সবাই খুশী থাকেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে তার নেতৃত্বে সকলে মেনে নিতে পারেন (আল আহকামুস সুলতানানিয়া। নেতা নির্বাচনের সময় ভোটারগণের দায়িত্ব হলো কমপক্ষে যে নেতার মধ্যে ৫টি ভাল গুণ থাকবে তাকে ভোট দিয়ে নেতা নির্বাচিত করা যাবে। গুণাবলিগুলি হলোÑ ১) ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হওয়া। (২) জ্ঞানী ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া। (৩) দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা থাকতে হবে। (৪) আমানতদার ও সত্যবাদী হওয়া। (৫) মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াককুল থাকা। (৬) সকল কাজের জন্য আল্লাহর দরবারে জওয়াবদিহির ভয় থাকা। উক্ত গুণাবলির সাথে আরো একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে তাহলো বয়সে প্রবীণ হওয়া। এসব গুণাবলী দেখে ভোট দিলে আমানত যথাস্থানে রক্ষিত হবে। অন্যথায় আমনতের খিয়ানত হবে। যাদেরকে ভোট দিলে আমানত খিয়ানত হবে তারা হলেনÑ (১) আল্লাহর অবাধ্য নাস্তিক মুরতাদ, যারা কুরআন ও সুন্নাহের বিরোধী (সুরা ফোরকান, আয়াত-৫২)। (২) মুনাফিক (আহযাব, আয়াত-৪৮), ও মিথ্যাবাদী (কলম, আয়াত-৮১)। ৪। চরিত্রহীন ও অসৎ নেতৃত্বকে (কালাম, আয়াত ১০-১২), ৫। সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নেতৃত্ব (শোয়রা ১৫১)। ৬। আল্লাহর বিধান অমান্যকারী নেতৃত্ব (আনআম ১৫০, বোখারী ও মুসলিম)। সম্মানিত পাঠক মহোদয়গণ উল্লেখিত খারাপ গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে আমাদের পবিত্র আমানত ভোট প্রদান করে যদি ক্ষমতাসীন করি তাহলে আমরা কাল কিয়ামতের ময়দানে শুধু আমানতের খিয়ানতকারী হিসাবে চিহ্নিত হবোনা, সাথে সাথে তাদের সকল অপকর্মের দায়ভারও আমাদের কাঁধে নিতে হবে। রাসুল (সাঃ) বলেন, কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির দিকে আল্লাহ থাকাবেন না, যে শুধুমাত্র দুনিয়াবী সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতাবান করল (বুখারী ও মুসলিম)। মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ, তিনি যেন আমাদেরকে সৎ, যোগ্য ও খোদাভীরু নেতৃত্ব উপহার দেন। আমীন।

লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ, খতিব ও সেক্রেটারী, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, কক্সবাজার জেলা
মোবাইল: ০১৮১৯-৮২১৭৭০।

 

পাঠকের মতামত: